ন্যাটোর সদস্য না হয়েও ন্যাটোর মিত্র হিসাবে কাতারের গুরুত্বের বোঝাপোড়া

  • উপসাগরীয় দেশটি মধ্যপ্রাচ্য থেকে ওয়াশিংটনের কৌশলগত পরিবর্তনে “কুটনৈতিক সফলতা” পেতে সাহায্যের হাত প্রসারিত করতে পারে। 

গত মাসের শেষের দিকে কাতারের আমীর শেখ তামিম বিন হামাদ আল থানি গল্ফ কর্পোরেশন কাউন্সিল  ভুক্ত প্রথম রাষ্ট্র প্রধান  যিনি জো বাইডেন প্রেসিডেন্ট হওয়ার পর ওয়াশিংটন সফর করেন।

এই সফরের সময় বাইডেন কাতার কে একটি ভালো বন্ধু ও নির্ভরযোগ্য মিত্র হিসাবে স্বাগত জানান এবং ন্যাটোর গুরুত্বপূর্ণ মিত্র হিসাবে মনোনীত করার  প্রতিশ্রুতি দিয়েছিলেন গল্ফ ভুক্ত দেশটিকে।এখন কাতার গল্ফভুক্ত তৃতীয় দেশ হিসাবে এই স্ট্যাটাস পেল, যারা বিশেষ “সামরিক বাণিজ্য ও নিরাপত্তা সহযোগিতা ” সহ “সামরিক এবং বাণিজ্যিক ” ভাবে লাভবান হবে।

এই সিদ্ধান্ত কোন হটকারিতায় ভরপুর ছিলো না যা ট্রাম্প প্রশাসনের আমলে নষ্ট হয়েছিল। এমনকি অনেক বিশ্লেষক পরবর্তীতে  বলার চেষ্টা করছে যে, এই সিদ্ধান্ত দোহার সাথে মার্কিন যুক্তরাষ্ট্রের গভীর সম্পর্কের ক্ষেত্রে  একটা পরিস্কার গুরুত্ব বহন করে যা বিভিন্ন ক্ষেত্রে বহু বছর ধরে ঘনিষ্ঠ সহযোগিতা পরিলক্ষিত হচ্ছে। 

এই রকম তিনটি বিষয় যুক্তরাষ্ট্রের প্রতি স্পষ্ট বার্তা বহন করে। 

১) আফগানিস্তানঃ

ওবামার যুগ থেকে পশ্চিমা বিশ্ব ও কাবুলের মধ্যে  কাতার খুবই কর্যকারী সংযোগ স্থাপনকারী হিসাবে কাজ করছে। এখন আমেরিকা পরবর্তী আফগানিস্তান, তালেবানরা দেশটির নিয়ন্ত্রণ নেওয়ার  ছয়মাস পরে ওয়াশিংটন ও দোহার সম্পর্কের গুরুত্ব বহুগুণে বাড়িয়ে দিয়েছে। 

গতবছর কাতার যুক্তরাষ্ট্রকে আফগানিস্তান ত্যাগ করতে সাহায্য করেছিল।তালেবান ক্ষমতা দখলের পর হাজার হাজার আফগানি কাতারে মাধ্যমে দেশ ত্যাগ করে।এই মধ্যমপন্থা অবস্থান এর উপর ভিত্তি করে ২০২১ সালের আগষ্ট থেকে ওয়াশিংটন এর পক্ষ থেকে বিশেষ ভুমিকা পালন করে।নভেম্বর মাসে  পররাষ্ট্রমন্ত্রী অ্যান্টনি ব্লিন্কেন ঘোষনা করেন যে, কাতার আনুষ্ঠানিক ভাবে আফগানিস্তানে  কুটনৈতিক প্রতিনিধি হয়ে  তার দূতাবাসের মাধ্যমে মার্কিন স্বার্থ সংশ্লিষ্ট বিষয়াদি  দেখাশোনা করে।

২)ইউরোপের জ্বালানি উদ্বেগঃ

শক্তিমত্তার দৃষ্টিকেণ থেকে দেখলে ইউক্রেন সংকট পশ্চিমা বিশ্বের উদ্বেগ ব্যাপকভাবে বৃদ্ধি পেয়েছে যা কাতারে দিকে কিছুটা মনোযোগ বৃদ্ধি পেয়েছে। যুদ্ধ শুরু হলে মস্কোর উপর নতুন নিষেধাজ্ঞা আরোপ হলে রাশিয়া ইউরোপীয় ইউনিয়ন ভুক্ত দেশের সাথে প্রতিশোধ হিসাবে ইউরোপের গ্যাস সরবরাহ লাইন  বন্ধ করে দিতে পারে এই আশঙ্কাও ব্যাপক ভাবে বিদ্যমান।যার ফলস্বরূপ কাতার তার গ্যাস সরবরাহ এশিয়ান দেশ গুলোর থেকে দূরে সরে যুদ্ধ পরিস্থিতিতে ইউরোপে সরবরাহ করতে পারে এই আলোচনা ইতিমধ্যে যুক্তরাষ্ট্র ও কাতারে মধ্যে বিদ্যমান রয়েছে। 

” আমাদের আরও একটা ভূ-রাজনৈতিক সমস্যা বিদ্যমান,অন্য একটা সুপ্ত সমস্যা রয়েছে যেটার থেকে উত্তরণের জন্য মার্কিন যুক্তরাষ্ট্র তার অংশীদার থেকে সাহায্য কামনা করছে, কাতার এই ভূ – প্রাকৃতিক দিক বিবেচনায় ইউক্রেন সংকট থেকে  অনেক দূরে অবস্থান করছে।তবে খুবই গুরুত্বপূর্ণ অবদান রাখতে পারে। “রয়েল ইউনাইটেড  সার্ভিসেস ইনস্টিটিউট এর ফেলো ডা.তবিজ বর্ক টিআরটি ওয়াল্ড এর সাথে একান্ত সাক্ষাৎকারে বলছিলেন।

কাতারের জন্য এই ধরনের পরিকল্পনা কতটা বাস্তব সম্মত তার থেকে কাতারের ইতিবাচক সাড়া দেওয়া গল্ফ ভুক্ত দেশটিতে যুক্তরাষ্ট্রের গুরুত্ব  কতটুকু সেটা বহন করে। 

 অন্যান উপসাগরীয় আরব দেশগুলো যখন মস্কোকে রাগান্বিত না করার সিদ্ধান্তে উপনীত হয়েছে যখন তারা ইউক্রেন থেকে যোজন যোজন দূরে রয়েছে। কাতার এক মাত্র উপসাগরীয় দেশ যারা ন্যাটোর এই সংকটময় মুহূর্ত পাশে আছে। 

৩)ইরানে পারমানবিক চুক্তিঃ

কাতার (JCPOA)চুক্তিটি পূর্বের অবস্থায় ফিরিয়ে আনার জন্য মার্কিন যুক্তরাষ্ট্র ও ইরানের শর্তগুলোর মধ্যে বড় ধরনের মতপার্থক্য কমাতে কাজ করছে। ৫ জাতিগোষ্ঠীর ও মার্কিনিদের সাথে করা চুক্তিটে পূর্বের অবস্থায়  ফিরিয়ে আনতে কাতারের নিজস্ব স্বার্থ রয়েছে।যেটা এভাবে ব্যাখ্যা করা যায় কেন কাতার এটা পূর্ণগঠন করতে সাহায্য করছে।

 

 গ্যাস রপ্তানির ক্ষেত্রে কাতারের কাছে হরমুজ প্রনালীর বিকল্প কোন রাস্তা নেই৷ একইভাবে  উপসাগরীয় অঞ্চলে যুদ্ধ বা আঞ্চলিক নিরাপত্তাহীনতার ঝুঁকি কমানোর উপায় হিসাবে পারমাণবিক চুক্তি পূর্ণ গঠনের দোহার প্রধান নিয়ামক হিসাবে কাজ করছে। 

 

বিশেষজ্ঞরা মনে করেন যে কাতার যুক্তরাষ্ট্র ও ইরানের পিছনের দরজা হিসাবে কাজ করছে, নিরপেক্ষতা বজায় রেখে  নিরাপত্তা ও অখন্ডা নিশ্চিত করতে সাহায্য করছে।বিশেষ করে দোহার বিদেশ নীতি এবং তেহরান – যুক্তরাষ্ট্রের সাথে শক্তিশালী সম্পর্কের কারণে আদর্শ নিয়ামকের কাজ করছে। 

 

 ওয়াশিংটন ডিসিতে আরব সেন্টার এর পরিচালক ডা.ইমাদ হারব বলছিলেন যে, “যুক্তরাষ্ট্র – ইরান এর মধ্যে মতপার্থক্য কমাতে কাজ করছে,কাতার তার কৌশলগত সম্পর্ক রক্ষা করে মৌলিক নীতি গুলো প্রয়োগ করছে যা ছোট রাষ্ট্র গুলি তাদের নিরপেক্ষতা খর্ব না করে নিরাপত্তা ও স্থিতিশীলতা নিশ্চিত করতে ব্যবহার করে।” 

 

“আফগানিস্তানের ক্ষেত্রে, কাতার মার্কিন যুক্তরাষ্ট্রের সর্বোত্তম স্বার্থ রক্ষাকারীর  কাজ করেছে যেটা এখন ইরান ক্ষেত্রেও পিছনের দরজার ভূমিকা পালন করছে। ২০১৫ সালে JCPOA চুক্তি  স্বাক্ষরিত হওয়ার  সময় ওমান পিছনের চ্যানেল হিসাবে কাজ করছে। ঐ সময় মার্কিন যুক্তরাষ্ট্র  ও ইরানের মধ্যে  গোপন আলোচনার ব্যবস্থা করেছিলো।”

 

“বিপরীতভাবে, ইরানের কাছে, কাতারের সাথে মার্কিন যুক্তরাষ্ট্রের চমৎকার সম্পর্কের জন্য গুরুত্বপূর্ণ নয় বরং দোহা আরব উপসাগরে গ্যাস মজুত ও উৎপাদনের ইরানের  অংশীদার। 

বাস্তবিক পর্যায়ে, তাদের নিজেদের মধ্যে বাণিজ্যিক স্বার্থ জড়িত রয়েছে। অধিকন্তু ২০১৭-২০২১ সাল পর্যন্ত কাতারের উপর  সৌদি,বাহারাই,মিশর ও আরব আমিরাত এর অবরোধ ঠেকানোর জন্য ইরান নিরালস ভাবে কাজ করেছে। “

 

“ইসলামি রিপাবলিকের ওব ইরানের  ভিতর ভয় কাজ করা উচিত নয় যেটা ভবিষ্যতে মার্কিন – ইরান সম্পর্কে বাজেভাবে ক্ষতিগ্রস্থ করে।

মধ্যপ্রাচ্যে ওয়াশিংটন এর কর্মপন্থাঃ

আমরা এমন একটা সময় কথা বলছি যখন বৃহত্তর পরিসরে আমেরিকা মধ্যপ্রাচ্য থেকে তার প্রভাব হারাচ্ছে এবং কৌশলগত স্থান পরিবর্তন করছে। সম্ভবত আমেরিকার কর্মকর্তারা ইরানের সাথে “কুটনৈতিক যোগাযোগ ” রক্ষা করার জন্য কাতার সহ এই অঞ্চলে অন্য দেশগুলের কাছে শরণাপন্ন হতে পারে।

 

এতকিছুর সত্বেও ওয়াশিংটন এর উপলব্ধি হলো এই অঞ্চলে সকল জিসিসি ভুক্ত দেশ গুলো আমেরিকার বিদেশ নীতির জন্য গুরুত্বপূর্ণ। যদি অন্য রাষ্ট্র গুলো ন্যাটোর সহযোগী দেশের মর্যাদা ভুক্ত নয়।মার্কিন যুক্তরাষ্ট্রের নেতৃত্বে কিছু আরব রাষ্ট্রকে মিত্র ভাবে যার মধ্যে আবুধাবি ও রিয়াদ কে রাখতে চাই এবং অন্যদের কে গুরুত্বপূর্ণ অংশীদার হিসাবে বিবেচনা করে।

“এর মানে এই নয় যে আমেরিকা পুরোপুরি মধ্যেপ্রাচ্য ত্যাগ করছে।তারা একটা উপসংহারে পৌচেছে যে আল -উইডিত বিমান ঘাটি  যেখানে আমেরিকান সেনাবাহিনী ও অন্যান্য দেশের বাহিনী) আছে সেটা আমেরিকার সেনাবাহিনীর জন্য খুবই গুরুত্বপূর্ণ  মধ্যপ্রাচ্যে তার প্রভাব ধরে রাখার জন্য। “ বলছিলেন ডা. বর্ক

 

“এই বাস্তবতার নিক্তিতে যুক্তরাষ্ট্রের কর্মকৌশল ও সামনে চলাচলের জন্য কাতার গুরুত্বপূর্ণ স্বীকৃতি বহন করে। “

 

বিগত দুই দশক ধরে কাতারকে ঘিরে যত বির্তকই থাকুক না কেন কাতারের এই মর্যাদাটি পশ্চিমা দেশগুলোর কাছে কাতারের সাথে সম্পর্ক মৌলিকভাবে যে গুরুত্বপূর্ণ সে ক্ষেত্রে দোহা কতটুকু এগিয়েছে তার পদচিহ্ন বহন করে।

 প্রকৃত পক্ষে  মার্কিন কর্মকর্তারা বছরের পর বছর ধরে কাতারকে হামাস,মুসলিম ব্রাদাহুড,তালিবানের সাথে সম্পর্ক থাকার কারণে লক্ষ্যবস্তুতে পরিণত করেছে। ওয়াশিংটন এর কিছু প্রতিষ্ঠান কাতারকে একটি ঘনিষ্ঠ আরব মিত্র হিসাবে বিবেচনা না করে জঙ্গিবাদ ও সন্ত্রাসবাদ এর মদদদাতা হিসাবে অভিযুক্ত করেছে।

“একটা সময় ছিলো যখন 

ইউএস প্রতিষ্ঠান ও ইউএস সরকার প্রশ্ন করতো, কাতার কিভাবে দাঁড়িয়ে আছে?” এই প্রশ্নের উত্তর ডা.আন্দ্রেয়াস ক্রিগ টিআরটিকে  এভাবে দিয়েছেন যিনি কিংস লন্ডন কলেজে নিরাপত্তা বিষয়ক অধ্যাপক 

কাতার সর্বদা মোটামুটি  একটা নিরপেক্ষে  খেলোয়াড়,বিভিন্ন দ্বন্দ্বের মধ্যে সকল পক্ষের সাথে সম্পর্ক রক্ষা করে চলে। যেটা সাধারণত  পশ্চিমারা বিশ্বস্ততা, অনুমান যোগ্য ও নির্ভর যোগ্য হিসাবে ভাবতে পারত না। কিন্তু আমি মনে করি যে, মার্কিন যুক্তরাষ্ট্র ও তার অন্যান্য মিত্ররা যুদ্ধ- বিধ্বস্ত  অঞ্চলে  একটি নিরপেক্ষ দেশের সত্যিকারের মূল্য বুঝতে পরেছে”

মূল লেখকঃ-জর্জিও ক্যাফিয়েরো

টিরআটি ওয়াল্ড অবলম্বনে 

 

 361 total views,  1 views today

Leave a Comment

This site uses Akismet to reduce spam. Learn how your comment data is processed.